বৃহস্পতিবার, ০২ অক্টোবর ২০২৫, ০৬:৫০ অপরাহ্ন
ড. এম এ মোমেন:
বাঘ ছুঁলে কত ঘা আর পুলিশ ছুঁলে কত, এ নিয়ে যত বিতর্কই থাকুক, বাঘ ঘা দেওয়ার অপবাদ থেকে বেরোতে না পারলেও পুলিশ কিন্তু এবার বেরিয়ে এসেছে। হালে পুলিশি হেফাজতে (হেফাজতকে গ্রেপ্তার এবং কারাবাসের সমার্থক মনে করা সমীচীন হবে না) থেকে উত্তম খানাপিনার যে সচিত্র সংবাদ ছাপামাধ্যম, ইলেকট্রনিক মাধ্যম এবং সামাজিক মাধ্যিেম প্রচারিত হয়েছে, তাতে পুলিশদর্শন অচিরেই সৌভাগ্য ও উত্তম আহার লাভের সম্ভাবনার সমার্থক হয়ে উঠতে পারে। হেফাজতের মানে নিরাপত্তা তো হতেই হবে, এর মানে ভাগ্যবানও। খেয়ে কে কবে ভাইরাল হয়েছেন, ভাগ্যবান না হলে কি আর গণমাধ্যম গেস্ট আর হোস্টের প্রতি এত আগ্রহী হয়? এত খাবারের ছবি দেখে আমাদের শৈশবের পাঠ্য জসীম উদ্্দীনের কবিতার কিছু পঙ্্ক্তি মনে পড়েছে। ‘আমার বাড়ি যাইও ভোমর/ বসতে দেব পিঁড়ে/ জলপান যে করতে দেব/ শালি ধানের চিঁড়ে।’
হেফাজতে আসা আমন্ত্রিত অতিথির মনে কীসের ভয় কে জানে, কেন যে একটু একটু করে সব পদ খাননি! উপেক্ষিত খাবারও নাকি কষ্ট পেতে জানে।
কেন খাবেন না? কলকাতা পুলিশের কথা শুনুন : কলকাতার পুলিশ সেকালে ভিন্ন ধরনের এক কল্পিত অপরাধের আশ্রয় নিতেন : ব্যাটা বড্ড বেড়ে গেছে, সাহেব মারার মামলায় ফাঁসিয়ে দে। সাহেব মানে সাদা চামড়ার সাহেব। সাহেব মারা গুরুতর অপরাধ। সরকারি ডাক্তার হরগোবিন্দ চট্টোপাধ্যায়কে পুরোদস্তুর একজন বাঙালি দারোগা (এসআই, দারোগার নিজের ভাষায় এছাই) সাহেব মারার মামলায় সাক্ষ্য দিতে বললে তিনি চটে গেলেন। মিথ্যা সাক্ষ্য তিনি কেন দেবেন?
দারোগা ধরেই নেন সরকারি চাকরি করবে, বেতন নেবে আর সরকারের পক্ষে দাঁড়াবে না তা কী করে হয়? হরগোবিন্দ নিজেকে কী মনে করেন? হরগোবিন্দ যে তলে তলে একজন স্বদেশি। এ অনাচার তার পক্ষে সহ্য করা সম্ভব নয়। তিনি দারোগাকে রীতিমতো ‘গেট-আউট’ করে দিলেন।
হরগোবিন্দের মতো মানুষ দারোগাকে অমান্য করেন! একি কলিকাল! দারোগা মামলা দিয়ে হরগোবিন্দের দুই পুত্রকে জেলে পাঠায়। হরগোবিন্দ তাকে রাষ্ট্রীয় কাজে বাধা দিয়েছেন এবং লাঞ্ছিত করেছেন এই আবেদন আদালতে পেশ করে খানা-তল্লাশির অনুমতি নিয়ে আসেন।
হরগোবিন্দ তার মেয়েদের রান্নাঘরে ঢুকিয়ে দরজা বন্ধ করে দারোগার নজর থেকে দূরে রাখতে পাহারা দিচ্ছিলেন। তল্লাশির সময় ব্র্যান্ডি ভেবে দারোগা বোতল থেকে তরল ঢেলে পান করেন, সে রাতেই তার অবস্থা মর মর হয়ে যায়। দারোগার স্ত্রী স্বামীর প্রাণ বাঁচাতে ডাক্তার হরগোবিন্দের শরণাপন্ন হলে তিনি চিকিৎসকের নৈতিক দায়িত্ব পালন করেন। বিশিষ্ট এই দারোগা খানা তল্লাশির আদেশ পেতে আদালতে যে আর্জি পেশ করেছেন বানান অক্ষত রেখে তা হুবহু উপস্থাপন করা হলো :
‘বিচারপতী
হুজুরের হুকুম মোতাবেক সাহেব মারার মোকর্দ্দমার তদন্ত করিতে করিতে আরও দুই আসামীর নাম প্রাপ্ত হওয়া গিয়াছে অৎয়চন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ও শুসীলচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। ইহাদের পীতা সরকারী ডাক্তার হরগোবীন্দ চট্টোপাধ্যায় হয়। অজয়চন্দ্র অতী দুর্দ্দান্ত বেক্তী কলিকাতার সুরেন্দ্রবাবুর কলেজে অধ্যায়ন করে প্রকাশ তাহারাই হুকুম সূত্রে অন্যান্য আসামীগণ শাহেবকে মাইরপীট করিয়াছে দুইজনকে ৫৪ ধারা অনুসারে অদ্যই ধৃত করিবার বন্দোবস্ত করিয়াছী।
২। বিসেস তদন্তে আরও জানিয়াছী উক্ত অজয়চন্দ্র কলিকাতা বীভিন স্কোয়ার হাঙ্গামাতে লীপ্ত ছিল সে এখানে আসিয়া একটি লাঠীখেলা সমিতী স্থাপন করিয়াছে তাহাতে স্থানীয় অনেক লোক চাঁদা দেয় ডাক্তারের ছোট পুত্র শুসীলচন্দ্র অল্প বস্ক হইলেও অত্যন্ত দুষ্ট সে এখানে অনেক বালক লইয়া একটি ঢীল ছোঁড়া সমিতী স্থাপন করিয়াছে উদ্দেশ্য সাহেব মেম দেখিলেই ঢীল ছুঁড়িবে।
৩। গোপন অনুসন্ধানে জানিলাম উক্ত ডাক্তারের বাসায় সাহেব মারা রক্তাক্ত লাঠী প্রভিতী লুক্কাইত আছে লাঠীখেলা সমিতির চাঁদার খাতা মেম্বরের তালিকা দৃষ্টে অনেক আসামীর আস্কারা হইতে পারে বিধায় প্রার্থনা ফৌঃ কাঃ বিঃ ৯৬ ধারা অনুসারে উক্ত হরগোবীন্দ ডাক্তারের বাটী খানাতল্লাসী করিতে ছার্চ্চ ওয়ারেন্ট দিয়া শুবিচার করিতে আগ্যা হয়।
আগ্যাধীন
শ্রী বদনচন্দ্র ঘোষ
এছাই’
একই দিনের খবর অন্য একটি সরকারি অফিসে গিয়ে একজন জলপান তো দূরের কথা, শুনে এলেন, তিনি নাকি ইন্তেকাল করেছেন।
ইন্তেকাল করা ঠেকানো যাবে না, কিন্তু জীবদ্দশায় কে-ইবা ইন্তেকাল করেছেন বলে গলা উঁচিয়ে বলতে যাবেন, নিজের পরিচয় দেওয়ার সময় বলবেন, আমি মরহুম মহিউদ্দিন?
দিনক্ষণ স্মরণ নেই, কাগজে পড়েছি ভারতের বিহারের ঘটনাটি। কিঞ্চিত রাষ্ট্রীয় সহায়তা গ্রহণের জন্য দরিদ্র মানুষটি বহু পথ পেরিয়ে যখন শহরে এসে সরকারি দপ্তরে হাজির হলেন, শুনলেন তিনি মৃত। হাত-পা নাড়ছেন, কথা বলছেন, ঢোক গিলছেন, অক্সিজেন টানছেন, কার্বন ডাই-অক্সাইড ছাড়ছেন তবুও তিনি মৃত!
তিনি বললেন, তাহলে আমি কে?
সদর অফিসের মেজো স্যার বললেন, তুমি আসলে তুমি নও, তুমি অন্য কেউ। সুতরাং ইমপার্সোনিফিকেশনের ফৌজদারি অপরাধে তোমাকে এবার লটকে দেওয়া যাবে। তাকে শিকের ভেতর ঢুকিয়ে দেওয়া হবে। নিজেকে জীবিত প্রমাণ করার আপ্রাণ চেষ্টা ব্যর্থ হওয়ার পর ফৌজদারিতে সোপর্দ হওয়া ঠেকাতে ঘাটে ঘাটে ঘুষ দিতে শুরু করলেন। সর্বস্বান্ত হয়ে নিজেই স্বীকার করে নিলেন তিনি আসলে মৃত, তিনি ইন্তেকাল করেছেন।
সর্বস্বান্ত মানুষটির শুরু হলো অনাহার জীবন। এমনিতেই মৃত্যু ঘটত কিন্তু সরকারকে বিব্রত করার জন্য সরকার বিরোধীদের প্ররোচনায় লোকটি আত্মহত্যা করলে সরকার নড়ে চড়ে বসল; নিরপেক্ষ তদন্তে প্রমাণিত হলো মৃত মানুষটি অবশ্যই জীবিত ছিলেন, জীবিত না হলে তার মরার কোনো সুযোগই ছিল না। এমন ঘটনা হামেশাই ঘটে আপনার আশপাশে ঘুরঘুর করা লোকটি মৃত না জীবিত আপনি কী নিশ্চিত?
জুলাই মাসের শেষে যুগান্তর পত্রিকায় জীবিত প্রতিবন্ধী মহিউদ্দিনকে নিয়ে একটি সচিত্র সংবাদ ছেপেছে : মহিউদ্দিন প্রতিবন্ধী ভাতা তুলতে ভোলা জেলায় লালমোহন সমাজসেবা অফিস গিয়ে জানলেন তাকে ভাতা প্রদান একবারে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে, কারণ তিনি মৃত, তিনি ইন্তেকাল করেছেন।
মহিউদ্দিন মৃত হয়ে থাকলে সমাজসেবা অফিস বিজ্ঞজনোচিত কাজ করছে। মৃত মানুষ বাংলাদেশি টাকা দিয়ে কী করবে। যতদূর জানা যায়, ডলার পাউন্ড আর ইউরোর মতো আন্তর্জাতিক মুদ্রারও পরপারে কোনো ব্যবহার নেই, ইয়েন, ইউয়ান, রুপি কেনোটারই না। ওপারে বার্টার ট্রেডও হয় না। মৃত মহিউদ্দিন তাহলে টাকা দিয়ে কী করবেন?
শৈশবের দুরারোগ্য ব্যাধিতে মহিউদ্দিনের দুই পা প্যারালাইজড হয়ে যায়। তিনি প্রতিবন্ধী হিসেবে স্বীকৃত হন। প্রতিবন্ধীদের জন্য রাষ্ট্রীয় ভাতা চালু হলে তিনি ভাতার আবেদন করেন এবং ২০০৭ সাল থেকে ভাতার মঞ্জুরি লাভ করেন। ২০২১ সালের অক্টোবরে ভাতা তুলতে গিয়ে জানলেন তিনি ইন্তেকাল করেছেন। মৃত মানুষ প্রতিবন্ধী হলেও ভাতা দাবি করতে পারেন না। তিনি রীতিমতো মৃত। সেই থেকে মহিউদ্দিন ইউনিয়ন পরিষদ অফিস- সমাজসেবা অফিসে ছোটাছুটি করছেন। ইউপি চেয়ারম্যান তার জ্যান্ত থাকার বিষয়ে সার্টিফিকেট দিলেও তাতে কাজ হয়নি। ৪৫ মাস ধরে সাধ্যমতো জীবিতের জীবনযাপন কিংবা সফলভাবে জীবিতের অভিনয় করে যাওয়ার পরও জীবিতের তালিকায় আর নাম উঠাতে পারেননি তিনি।
মহিউদ্দিনের নাম ইন্তেকাল করা মানুষের তালিকায়, কেমন করে এই তালিকায় এলো তাও তিনি জানেন না। মৃতের স্থায়ী তালিকায় কাটাছেঁড়া করে মহিউদ্দিনকে আবারও জীবিত করা সম্ভব?
সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের আওতায় প্রতিবন্ধীদের নিয়ে কিছু কর্মসূচি রয়েছে : প্রতিবন্ধী ভাতা, প্রতিবন্ধী শিক্ষা উপবৃত্তি, প্রতিবন্ধিতা শনাক্তকরণ, প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের প্রশিক্ষণ, সমন্বিত দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী শিক্ষা, দৃষ্টি ও বাক-শ্রবণপ্রতিবন্ধী বিদ্যালয়, জাতীয় বিশেষ শিক্ষাকেন্দ্র, মানসিক প্রতিবন্ধী শিশুদের প্রতিষ্ঠান। মহিউদ্দিন ছিলেন ভাতার দাবিদার।
***
২২ মার্চ ২০২২ আসামের শিলচরের মৃত শ্যামাচরণ দাস সেখানকার রাজ্য সরকারের জরুরি একটি চিঠি পেয়েছেন, ঠিক তিনি পাননি, তার নামে আসা চিঠি তার স্ত্রী রিসিভ করেছেন। চিঠিতে বলা হয়েছে, আপনি আদৌ ভারতীয় নাগরিক কি না তার প্রমাণপত্রসহ অবিলম্বে হাজির হন। শ্যামাচরণ দাস তো শ্মশানে ভস্মীভূত হয়ে গেছেন। কেমন করে যে নিজেকে গুটিয়ে পুনরায় রূপান্তরিত হয়ে কাগজপত্র নিয়ে সরকারের দরবারে হাজির হবেন?
৬ মে ২০১৬ যে মানুষটি মৃত্যুবরণ করেছেন চার বছর পর ভৌতিক চলচ্চিত্র ‘ডেড ম্যান ওয়াকিং’ করে আদেশদাতার সামনে হাজির হলে তিনি স্থির থাকতে পারবেন তো? শ্যামাচরণ পুনরায় মৃত্যুবরণ করার একটি দুর্লভ সুযোগ পেয়ে গলেন। তার পরিস্থিতি অন্যদের ঠিক উল্টো। তাকে মৃত প্রমাণ করার জন্য তার স্বজনরা সরকারি অফিসে ধরনা দিচ্ছে।
***
আপনি যে জীবিত তার প্রমাণ কী? আপনি বলবেন, এই যে আমি দেখুন চিমটি কাটলে ব্যথা পাচ্ছি, পুলিশ দেখলে দৌড় দিচ্ছি, নেতা দেখলে মা-বাপ তুলে গাল দিচ্ছি।
তাতে কী? আপনি যদি ট্যাঙ্গো নাচও দেখান তাতেও প্রমাণিত হবে না যে, আপনি বেঁচে আছেন।
২০০০ সালের জুন মাসে কলম্বিয়ার রাজধানী বোগোটার গণপূর্ত বিভাগের একজন সাবেক কর্মচারী ৮৭ বছরের আর্তুরো সুস্পে পেনশনের টাকা তোলার লাইনে দাঁড়িয়ে শুনলেন তাকে সার্ভাইভাল সার্টিফিকেট দিতে হবে, কিছুক্ষণ লাইনে থাকার পর ঢলে পড়লেন। বুড়ো মরার আর জায়গা পায় না! মৃত্যুর চেয়ে ভালো মুক্তিদাতা আর কে আছে!
বোগোটায় জীবিত প্রমাণ করতে আর্তুরো সুস্পেকে মৃত্যুবরণ করতে হয়েছিল।
বাংলাদেশের মহিউদ্দিনকেও কি সেই পথ ধরতে হবে নাকি?
রবীন্দ্রনাথের কাদম্বিনীর কথা মনে পড়ে? যাকে মরে প্রমাণ করতে হয়েছে যে তিনি মরেননি।
লেখক: সরকারের সাবেক কর্মকর্তা ও কলামিস্ট, momen98765@gmail.com
সূত্র: দেশ রূপান্তর/ভয়েস/আআ